শনিবার ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ - ০৬:৩০
ইমাম মাহদী (আ.ফা.) কি নতুন কোনো ধর্ম নিয়ে আবির্ভূত হবেন?

ইমাম মাহদী (আ.ফা.) কি “নতুন কোনো ধর্ম” নিয়ে কিয়াম করবেন? এ বিষয়ে উত্থাপিত সংশয় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট হয়—হাদিসে যাকে “নতুন বিষয়” (امر جدید) বা “নতুন আদেশ” বলা হয়েছে, তা কোনো ধর্মীয় পরিবর্তন বা নতুন শরিয়তের সূচনা নয়; বরং এমন এক যুগে আল্লাহর পরিপূর্ণ ন্যায়বিচারের বাস্তবায়ন, যখন মানববুদ্ধি পূর্ণতা ও পরিপক্বতার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছাবে এবং সেই একই ঐশী ফিতরাতভিত্তিক ধর্ম তার পূর্ণ রূপে কার্যকর হবে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: কিছু বর্ণনায় এসেছে যে হযরত হুজ্জাত ইবনুল হাসান (আ.ফা.) তাঁর যুহূরের সময়ে “নতুন ধর্ম” অথবা “নতুন আদেশ” নিয়ে কিয়াম করবেন এবং তিনি নাকি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি)-এর প্রচলিত সীরাত অনুযায়ী আমল করবেন না।

অন্যদিকে, অসংখ্য সহিহ হাদিসে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সকল নিষ্পাপ ইমাম (আ.) ওহির অনুসরণ এবং আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের জন্যই প্রেরিত ও নিযুক্ত ছিলেন। তাঁদের সীরাত ছিল ন্যায় ও ফিতরাতের ওপর সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং প্রশ্ন ওঠে—কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে যে ইমাম মাহদী (আ.ফা.) কার্যত রাসূলুল্লাহ (সা.) বা পূর্ববর্তী ইমামদের পথ থেকে বিচ্যুত হবেন এবং তাঁদের ধর্ম ব্যতীত অন্য কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠা করবেন?

উত্তর: এই সংশয়ের যথাযথ সমাধান এবং সংশ্লিষ্ট সব বর্ণনার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য একটি মৌলিক বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া আবশ্যক— তা হলো উম্মতসমূহের ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতার পার্থক্য।

রাসূলুল্লাহ (সা.) ও পূর্ববর্তী ইমামগণ (আ.) এই নীতির আলোকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন—

إنّا معاشر الأنبیاء أُمرنا أن نُکلّم الناس علی قدر عقولهم

অর্থাৎ, মানুষ যতটুকু বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা রাখে, তাদের সঙ্গে ততটুকুই কথা বলতে হবে এবং সেই অনুযায়ী আল্লাহর বিধান ব্যাখ্যা ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এ কারণেই তাঁরা মানুষের উপলব্ধির স্তর অনুযায়ী শরিয়তের বিধান প্রচার ও প্রয়োগ করতেন। বর্তমান গায়বাতের যুগেও ফকিহগণ কুরআন ও সুন্নাহর বাহ্যিক দলিলের ভিত্তিতে ফতোয়া প্রদান করেন এবং মুসলিম সমাজ পরিচালনা করেন।

কিন্তু যুহূরের যুগে মানববুদ্ধি তার সর্বোচ্চ পরিপূর্ণতায় পৌঁছাবে এবং মানুষের ফিতরাতগত যোগ্যতা সত্য ও বাস্তবতাকে উপলব্ধি ও গ্রহণ করার জন্য সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হবে।

এই পর্যায়ে হযরত হুজ্জাত ইমাম মাহদী (আ.ফা.) আল্লাহর বিধানসমূহ বাস্তবায়ন করবেন ঐশী ফিতরাত এবং সৃষ্টিজগতের অস্তিত্বগত বাস্তবতার ভিত্তিতে। তবে এর অর্থ কখনোই এই নয় যে তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সীরাতের বিরোধিতা করবেন। বরং তিনি গায়বাতের দীর্ঘ সময়ে সমাজে গড়ে ওঠা সেইসব কৃত্রিম রীতি, অভ্যাস ও বাহ্যিক স্বস্তিকে বাতিল করবেন, যেগুলো প্রকৃত ঐশী ন্যায়বিচারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

অতএব, হাদিসে ব্যবহৃত “নতুন ধর্ম”, “নতুন আদেশ” কিংবা “নিজের জ্ঞানের ভিত্তিতে বিচার করবেন”—এসব অভিব্যক্তির উদ্দেশ্য হলো ঐশী ফিতরাতভিত্তিক ধর্মের পূর্ণ ও সর্বোচ্চ বাস্তবায়ন, কোনো নতুন ধর্মের প্রবর্তন নয়।

কিছু রেওয়াতের বর্ণনায় আরও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে পূর্ববর্তী নবীদের যুগে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতার কারণে ফিতরাতভিত্তিক গভীর জ্ঞান প্রকাশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু হযরত হুজ্জাত ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর রাষ্ট্রে, যেহেতু মানুষের বুদ্ধি পূর্ণতায় পৌঁছাবে, তাই পরম ন্যায়বিচার ও ঐশী ফিতরাতের ধর্ম সম্পূর্ণরূপে কার্যকর হবে। এ প্রসঙ্গেই আল্লাহ তাআলা বলেন—

فِطْرَتَ اللَّهِ الَّتِی فَطَرَ النَّاسَ عَلَیْهَا لَا تَبْدِیلَ لِخَلْقِ اللَّهِ، ذَٰلِکَ الدِّینُ الْقَیِّمُ وَلَٰکِنَّ أَکْثَرَ النَّاسِ لَا یَعْلَمُونَ


চূড়ান্ত উপসংহার:
সুতরাং স্পষ্টভাবে বলা যায়, ইমাম মাহদী (আ.ফা.) যে ধর্ম নিয়ে আবির্ভূত হবেন, তা মূলত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এরই ধর্ম। পার্থক্য কেবল এটুকু যে, যুহূরের যুগে সেই ধর্ম তার ফিতরাতগত ও অন্তর্নিহিত বাস্তবতার সর্বোচ্চ স্তরে বাস্তবায়িত হবে। আর মানুষ তখন বুদ্ধি ও জ্ঞানের পূর্ণ বিকাশের কারণে সেই স্তরের ন্যায়বিচার গ্রহণ ও ধারণ করার সক্ষমতা অর্জন করবে।

গ্রন্থসূত্র: কিতাব আশ-শুমূসুল মুদিয়্যা (যুহূরে নূর), পৃষ্ঠা ৩৪২।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha